Press ESC to close

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে বিরোধ: ইতিহাসের এক জটিল অধ্যায়

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের বিরোধ কেবল আধুনিক যুগের একটি সমস্যা নয়; এটি মূলত শতাব্দী প্রাচীন দ্বন্দ্ব, যা বহু ভৌগোলিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই বিরোধের মূল শিকড় রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক ঘটনায়। একদিকে ইহুদিদের ঐতিহাসিক ভূমি হিসাবে ইসরায়েলের দাবি, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার ও আত্মপরিচয়ের লড়াই—এই দুই বিপরীতমুখী দাবির কারণে সংঘাত বহুস্তরবিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।

আধুনিক বিশ্বে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার এই অঞ্চলটি শুধুমাত্র ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি তিনটি প্রধান ধর্মের (ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম) পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই, এই বিরোধ শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে নয়; এটি ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গেও জড়িত।

এই প্রবন্ধে আমরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পটভূমি, ইতিহাসের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো এবং আধুনিক যুগের সংঘাত বিশদভাবে আলোচনা করব। আসুন, শুরু করি ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট দিয়ে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি শতাব্দীপ্রাচীন ইহুদি আকাঙ্ক্ষার ফল। প্রাচীন কালে ইহুদিরা বিশ্বাস করতো যে তারা “প্রতিশ্রুত ভূমি”র অধিকারী। এই ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের বহু শতাব্দী ধরে পুনরায় প্রাচীন ইসরায়েল ভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করে।

আধুনিক যুগে এসে এই আকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক রূপ নেয় যখন ১৯ শতকের শেষের দিকে জায়নবাদ আন্দোলন শুরু হয়। এর পেছনে ইহুদিদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডে পুনরায় বসতি স্থাপনের প্রয়াস ছিল। কিন্তু এই ভূখণ্ডে আরব মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল, যা পরবর্তীকালে সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রাচীন ইসরায়েল এবং ইহুদি ধর্ম

বর্তমান ইসরায়েল অঞ্চলে ইহুদিদের ইতিহাস প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো। এই অঞ্চলে ইহুদি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ইহুদি সংস্কৃতি ও পরিচয়ের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। বাইবেল অনুসারে, এই ভূমি ছিল ইহুদিদের ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি, যেখানে আব্রাহাম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের মতো প্রধান চরিত্রের বসবাস ছিল।

ইহুদি ধর্মের মূল ভিত্তি ছিল একেশ্বরবাদ, যা সেই সময়ের জন্য ছিল একটি নতুন ধারণা। অন্যান্য ধর্মগুলির মতো বহুদেবতাবাদে বিশ্বাস না রেখে, ইহুদি ধর্ম একক সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের উপাসনা করতো। প্রাচীন ইসরায়েল রাজ্যটি এই ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এবং সলোমন মন্দির ছিল এর প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র।

প্রাচীন ইসরায়েলের পতন এবং ইহুদি বিতাড়ন

প্রাচীন ইসরায়েলের পতন ঘটে একাধিক সাম্রাজ্যের আগ্রাসনে। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ সালে আসিরীয় সাম্রাজ্য প্রথমে ইসরায়েল রাজ্য দখল করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যাবিলনীয়রা দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস করে। রোমান সাম্রাজ্য যখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, তখন তারা ইহুদিদের বিদ্রোহের জবাবে ব্যাপকভাবে বিতাড়ন করে।

এই বিতাড়ন কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না; এটি ছিল ইহুদিদের সংস্কৃতি ও ধর্মের ওপর বড় ধরনের আঘাত। ইহুদিরা এই সময় থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং মূলত ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করতে থাকে।

ইউরোপে ইহুদিদের উপর নির্যাতন

ইউরোপে ইহুদিদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস বহু পুরনো এবং এটি মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়। খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের নিয়ে বহু ভুল ধারণা ছিল এবং প্রায়শই তাদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে লক্ষ্যবস্তু করা হতো।

বিশেষ করে ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে নাৎসি জার্মানির সময় ইহুদিদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ইহুদিদের গণহত্যা চালায়, যা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এই গণহত্যায় প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদি প্রাণ হারান। এই ঘটনার পর ইহুদিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার তীব্র অনুভূতি প্রকাশ করে।

ইহুদি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার ধারণা এবং জায়নবাদ

ইহুদি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার ধারণা মূলত ইউরোপে ইহুদিদের উপর চলমান নির্যাতন এবং বৈষম্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ১৯ শতকের শেষের দিকে, ইহুদিরা দেখেছিল যে তারা কোথাও সুরক্ষিত নয়; তাদের ওপর নির্যাতন চলতেই থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল “পোগ্রোম” নামে পরিচিত গণহত্যা ও লুটপাট, যা রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হতো।

এই পটভূমিতে, ইহুদিদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই জন্ম নেয় “জায়নবাদ” আন্দোলন। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের ঐতিহাসিক ভূমি প্যালেস্টাইনে ফিরে যাওয়া এবং সেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। জায়নবাদীরা বিশ্বাস করতো, শুধুমাত্র একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রই তাদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।

থিওডর হার্জল এবং জায়নবাদী আন্দোলন

থিওডর হার্জলকে “জায়নবাদের জনক” বলা হয়। তিনি ছিলেন একজন ইহুদি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা, যিনি ১৮৯৬ সালে “দ্য জিউইশ স্টেট” নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে তিনি ইহুদিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। হার্জল বলেছিলেন যে, ইহুদিদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে হলে তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র থাকা জরুরি।

হার্জলের নেতৃত্বে প্রথম জায়নবাদী কংগ্রেস ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি জাতীয় আন্দোলন শুরু করা হয়, যা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইহুদিরা তৎপর হয়ে তাদের ঐতিহাসিক ভূমি প্যালেস্টাইনে ফিরে যাওয়ার জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে এবং সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বেলফোর ঘোষণা, এবং ব্রিটিশ শাসন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বের ভূরাজনীতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু অঞ্চল ইউরোপীয় শক্তির অধীনে আসে। প্যালেস্টাইন অঞ্চল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং এটি “ব্রিটিশ ম্যান্ডেট” নামে পরিচিত হয়।

১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর “বেলফোর ঘোষণা” জারি করেন, যেখানে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় গৃহ প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানানো হয়। এটি ছিল একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ, যা ইহুদিদের মধ্যে আশার আলো দেখায়। কিন্তু একইসঙ্গে এটি আরব জনগণের মধ্যে হতাশা ও বিরোধ সৃষ্টি করে, কারণ তারা এই ভূমিকে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি মনে করতো।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এবং প্যালেস্টাইনে উত্তেজনা বৃদ্ধি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদি অভিবাসন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রশাসন এই অভিবাসনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করলেও ইহুদিরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে। এই সময়ে আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে, কারণ তারা দেখছিল যে তাদের ভূমি ক্রমশ ইহুদিদের দখলে চলে যাচ্ছে।

ইহুদি এবং আরবদের মধ্যে এই বিরোধ ক্রমশ সহিংস রূপ নেয়। আরব জনগণ ইহুদি বসতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে, যা “আরব বিদ্রোহ” নামে পরিচিত। ব্রিটিশ প্রশাসন এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয় এবং পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে ওঠে। ফলে, প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ইহুদি-আরব বিরোধ আরও তীব্র হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। হলোকাস্টের সময় ছয় মিলিয়ন ইহুদির নির্মম হত্যাকাণ্ড ইহুদি জনগণের মধ্যে একটি স্থায়ী নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে। যুদ্ধের পর ইউরোপের বহু ইহুদি শরণার্থী হিসেবে প্যালেস্টাইনে যেতে শুরু করে।

এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ একটি বিভাজন পরিকল্পনা প্রস্তাব করে, যেখানে প্যালেস্টাইনকে দুটি ভাগে ভাগ করার কথা বলা হয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র। ইহুদিরা এই পরিকল্পনাটি মেনে নিলেও আরব দেশগুলো এবং ফিলিস্তিনি জনগণ এতে সম্মত হয়নি। এর ফলে, সংঘাত শুরু হয় এবং এটি ক্রমশ একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণাঃ ১৯৪৮

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইহুদি নেতা ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এটি ছিল ইহুদি জনগণের জন্য একটি বড় বিজয়, কারণ তারা বহু শতাব্দী পরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে, এই ঘোষণার পরপরই প্রতিবেশী আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে, যা “আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ” নামে পরিচিত।

এই যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয় লাভ করে এবং আরও ভূমি অধিকার করে। কিন্তু এই যুদ্ধ বহু ফিলিস্তিনিকে তাদের ভূমি থেকে উদ্বাস্তু করে তোলে, যা পরবর্তীতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং সংঘাতের শুরু

ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পরই সংঘাতের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরদিনই পাঁচটি আরব দেশ—মিশর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, এবং ইরাক—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধকে “১৯৪৮ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ” বা “ইসরায়েলের স্বাধীনতা যুদ্ধ” বলা হয়। ইসরায়েল মাত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও, তাদের সেনাবাহিনী দক্ষভাবে লড়াই করে এবং আরব বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। ফলস্বরূপ, ইসরায়েল তাদের ভূমি আরও বিস্তৃত করে এবং বহু ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে পড়ে।

এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিনি জনগণ উদ্বাস্তু হয়ে যায় এবং তাদের অধিকাংশ জর্ডান, লেবানন, এবং সিরিয়াতে আশ্রয় নেয়। এই উদ্বাস্তু সমস্যা আজও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের একটি প্রধান কারণ। ইসরায়েলের বিজয় আরব দেশগুলোকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে, যা পরবর্তীতে আরও কয়েকটি যুদ্ধের সূচনা করে।

১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট

১৯৫৬ সালে ইসরায়েল আবারও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, যা “সুয়েজ সংকট” নামে পরিচিত। মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন, যা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। এই পরিস্থিতিতে, ইসরায়েল, ব্রিটেন, এবং ফ্রান্স মিশরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়। ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ আক্রমণ করে এবং দ্রুত সেখানে অগ্রসর হয়।

যদিও সামরিক দিক থেকে ইসরায়েল সফল হয়েছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে তাদের পিছু হটতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে ইসরায়েল, ব্রিটেন, এবং ফ্রান্সকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়। সুয়েজ সংকটের পর, ইসরায়েল বুঝতে পারে যে তারা আরব দেশগুলোর বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হবে এবং নিজেদের সামরিক শক্তি আরও উন্নত করতে হবে।

ষাটের দশকে উত্তেজনার বৃদ্ধি এবং ছয় দিনের যুদ্ধ

১৯৬০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ইসরায়েলের সীমান্তে আরব দেশগুলো নিয়মিত হামলা চালায় এবং ফিলিস্তিনি গেরিলা সংগঠনগুলো ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে, ইসরায়েল নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

১৯৬৭ সালে এই উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং শুরু হয় “ছয় দিনের যুদ্ধ”। এই যুদ্ধে ইসরায়েল মিশর, সিরিয়া, এবং জর্ডানের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ইসরায়েল বিজয় অর্জন করে এবং গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, গোলান হাইটস, এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।

এই যুদ্ধের পর ইসরায়েলের ভূখণ্ড চারগুণ বেড়ে যায়। তবে, এই যুদ্ধের ফলাফল আরব দেশগুলোকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়।

১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধ

১৯৭৩ সালে, আরব দেশগুলো ইসরায়েলের উপর আরেকটি বড় আক্রমণ চালায়, যা “ইয়ম কিপুর যুদ্ধ” নামে পরিচিত। মিশর এবং সিরিয়া পরিকল্পিতভাবে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ চালায় এবং এই যুদ্ধে প্রথমদিকে ইসরায়েল কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। তবে, ইসরায়েল দ্রুত নিজেদের সামরিক শক্তি সংগঠিত করে এবং পাল্টা আক্রমণ চালায়।

এই যুদ্ধটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। যুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা শুরু হয়। ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পরে আরব দেশগুলো বুঝতে পারে যে তারা ইসরায়েলকে সামরিকভাবে পরাজিত করতে পারবে না, ফলে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে ইসরায়েলের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং মিশরের সাথে শান্তি

ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পরে, ইসরায়েল এবং মিশরের মধ্যে সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত উপলব্ধি করেন যে সামরিক পথে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় এবং তিনি ইসরায়েলের সাথে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৮ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিশর এবং ইসরায়েলের মধ্যে “ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তির মাধ্যমে মিশর ইসরায়েলকে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ মিশরের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম শান্তি চুক্তি, যা ইসরায়েল এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির পথ খুলে দেয়। তবে, এই চুক্তি মিশরের অভ্যন্তরে বিরোধ সৃষ্টি করে এবং প্রেসিডেন্ট সাদাতকে হত্যা করা হয়।

ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (PLO) এবং ইন্তিফাদা

১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (PLO) গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। PLO-এর নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার জন্য একটি সামরিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮০-এর দশকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি গণ-বিদ্রোহ শুরু হয়, যা “ইন্তিফাদা” নামে পরিচিত।

ইন্তিফাদা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের একটি গণআন্দোলন, যেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহিংস ও অহিংস প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। এই আন্দোলন বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। ইন্তিফাদার ফলে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে।

অসলো চুক্তি এবং শান্তির আশা

১৯৯০-এর দশকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (PLO) একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা “অসলো চুক্তি” নামে পরিচিত। এই চুক্তির মধ্যস্থতা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। অসলো চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন গঠনের জন্য কিছু ভূমি ফিরিয়ে দেয়। ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়িৎসাক রবিন একে অপরকে স্বীকৃতি দেন। এটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য একটি বড় পদক্ষেপ ছিল এবং উভয় পক্ষই চুক্তির মাধ্যমে শান্তির প্রতিশ্রুতি দেয়।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং সংঘাতের পুনরুত্থান

শান্তির চুক্তির পরে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। ২০০০ সালে, ইসরায়েলি নেতা এরিয়েল শ্যারনের আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শনের পর ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ চরমে পৌঁছে যায় এবং শুরু হয় “দ্বিতীয় ইন্তিফাদা”। এটি প্রথম ইন্তিফাদার তুলনায় অনেক বেশি সহিংস ছিল এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বড় আকারের সংঘর্ষ শুরু হয়।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালে, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়, আর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনি এলাকায় আক্রমণ করে। এই সংঘাত বহু নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং শান্তির প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলে এবং এর ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।

গাজা থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহার এবং হামাসের উত্থান

২০০৫ সালে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন সিদ্ধান্ত নেন গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করার। ইসরায়েল সব সেটেলমেন্ট সরিয়ে নেয় এবং গাজা ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এরপরই গাজা উপত্যকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস দল বিজয়ী হয় এবং গাজার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।

হামাস ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না এবং তারা সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। হামাসের শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গাজা এবং ইসরায়েলের মধ্যে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। ইসরায়েল গাজায় বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে, যা গাজার অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সাধারণ জনগণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ায়।

ইসরায়েল-গাজার যুদ্ধ এবং বোমা হামলা

২০০৮ সাল থেকে, গাজা এবং ইসরায়েলের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। প্রতিটি যুদ্ধেই ব্যাপক বোমা হামলা, রকেট হামলা এবং সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইসরায়েল দাবি করে যে তারা হামাসের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে চায়, আর হামাস ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যায়।

ইসরায়েল ও গাজার মধ্যে ২০১৪ সালের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ধ্বংসাত্মক। এই সংঘাতে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয় এবং বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয় পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানায়, কিন্তু পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে সময় লাগে।

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জ

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বহু প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে মধ্যস্থতা করেছে এবং শান্তি আলোচনা আয়োজন করেছে। তবে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে মূল সমস্যাগুলো সমাধান করা সহজ নয়। ভূমি, জেরুজালেমের মর্যাদা, শরণার্থী সমস্যার মতো বিষয়গুলো এখনও সমাধানহীন রয়ে গেছে।

আরব লিগ বিভিন্ন সময়ে শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে, যেখানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তবে, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি নেতাদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে শান্তির পথ বারবার ব্যাহত হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি: সংঘাত ও শান্তির সন্ধান

বর্তমানে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ হয়। গাজা থেকে রকেট হামলা চালানো হয়, আর ইসরায়েল পাল্টা বোমা হামলা করে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেটেলমেন্টের সম্প্রসারণ ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয় পক্ষকেই শান্তির পথে আসার আহ্বান জানায়। তবে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ধর্মীয় মতবিরোধ, এবং জাতীয় স্বার্থের কারণে সমস্যার সমাধান এখনো অনিশ্চিত।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লিগ সহ অনেক সংস্থা ও দেশ শান্তি স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ একাধিক প্রস্তাব পাস করেছে, যেখানে ইসরায়েলের সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণ এবং সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের প্রধান সমর্থক এবং অন্যতম কৌশলগত মিত্র হিসেবে কাজ করে আসছে। মার্কিন প্রশাসন মধ্যস্থতা ও শান্তি আলোচনা আয়োজন করেছে, যার মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের “ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি” ছিল উল্লেখযোগ্য। এই পরিকল্পনায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল, তবে ফিলিস্তিনিরা এটি প্রত্যাখ্যান করে, কারণ এটি ফিলিস্তিনি স্বার্থের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

জাতিসংঘের ভূমিকা ও মানবিক সহায়তা

জাতিসংঘ বিভিন্ন সময়ে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে। জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি (UNRWA) ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য সহায়তা প্রদান করে থাকে। তবে, ইসরায়েল জাতিসংঘের কার্যক্রমের সমালোচনা করে, দাবি করে যে তারা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। বিশেষত, গাজায় বোমা হামলা ও পশ্চিম তীরে সেনাবাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে তদন্ত হয়েছে।

আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকা পরিবর্তন

মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের সমর্থক ছিল। সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান “আব্রাহাম চুক্তি” স্বাক্ষর করে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

এই পরিবর্তন ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে, কারণ এটি তাদের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে। তবে, কিছু আরব দেশ এখনও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখেছে, যেমন সৌদি আরব এবং কাতার।

অর্থনৈতিক প্রভাব ও মানবিক সংকট

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাব গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি। ইসরায়েল একটি উন্নত অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, তবে সংঘাতের কারণে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের জন্য বিশাল অর্থ ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের অর্থনীতি চরম দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে, বিশেষত গাজা উপত্যকার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন।

ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজার অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, এবং খাদ্য সঙ্কট ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গাজার অধিকাংশ মানুষ আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরাও সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণ এবং অবরোধের কারণে জমির অধিকার হারাচ্ছে, যা কৃষি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

সংঘাতের সামাজিক প্রভাব উভয় পক্ষের মানুষের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য সহিংসতা একটি নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে ফিলিস্তিনি জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

ইসরায়েলি সমাজেও একটি সামরিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যেখানে যুবক-যুবতীদের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা করতে হয়। সংঘাতের কারণে উভয় পক্ষেই ভয়, ঘৃণা, এবং অবিশ্বাস বেড়ে চলেছে, যা ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গণমাধ্যম ও প্রচার যুদ্ধ

গণমাধ্যমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের রিপোর্টিংও একটি যুদ্ধের অংশ হয়ে উঠেছে। উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি অর্জনের জন্য প্রচার চালায়। ইসরায়েল নিজেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইরত একটি দেশ হিসেবে উপস্থাপন করে, যেখানে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখানো হয়। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে তুলে ধরা হয়।

সামাজিক মাধ্যমেও সংঘাতের চিত্র তুলে ধরা হয়, যা বিশ্বব্যাপী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। অনেক সময় বিভ্রান্তিকর বা পক্ষপাতমূলক তথ্য প্রচারিত হয়, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।

ধর্মীয় গুরুত্ব ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে ধর্মের একটি গভীর ভূমিকা রয়েছে, কারণ এই অঞ্চলে তিনটি প্রধান ধর্ম — ইসলাম, খ্রিস্টান, এবং ইহুদি ধর্ম — এর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মূল কেন্দ্র। জেরুজালেম শহরটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে ইহুদিদের কাছে পবিত্র ওয়েস্টার্ন ওয়াল, খ্রিস্টানদের কাছে চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার, এবং মুসলিমদের কাছে আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত।

ধর্মীয় নেতারা বিভিন্ন সময়ে সংঘাত নিরসনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, তবে অনেক সময় তাদের বক্তব্য উল্টো বিভেদও সৃষ্টি করেছে। মুসলিম ও ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি জেরুজালেমের ওপর নিয়ন্ত্রণের দাবি করে, যা একটি বড় মতবিরোধের বিষয়। কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতারা তাদের সমর্থকদের মধ্যে চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচার করেন, যা সংঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে।

ইসরায়েলের সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণ ও তার প্রভাব

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে নতুন সেটেলমেন্ট নির্মাণ করে, যেখানে ইসরায়েলি নাগরিকদের বসবাস করানো হয়। এই সেটেলমেন্টগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ বলে গণ্য হলেও, ইসরায়েল সরকার তা সমর্থন করে।

সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণের ফলে ফিলিস্তিনিদের জমি হারানোর সমস্যা বেড়েছে এবং পশ্চিম তীরের অধিকাংশ অংশে ফিলিস্তিনি অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকেও বিপন্ন করে তুলেছে, কারণ সেটেলমেন্ট নির্মাণের ফলে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক ধারাবাহিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রতিদিনের জীবন ও জনগণের দুর্ভোগ

গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিদিনের জীবন সংঘাত, অবরোধ, এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে বিপর্যস্ত। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অবরোধের ফলে বিদ্যুৎ সংকট, পানির অভাব, এবং চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি দেখা যায়। পশ্চিম তীরের জনগণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও সেটেলমেন্টের কারণে বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হয়।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি জনগণও হামাসের রকেট হামলার কারণে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করে। সীমান্ত অঞ্চলে ইসরায়েলি নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি রয়েছে এবং অনেক পরিবার বাঙ্কারে থাকতে বাধ্য হয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক তদন্ত

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং বসতি সম্প্রসারণের অভিযোগ রয়েছে। ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকেও হামাসের রকেট হামলা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, উভয় পক্ষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করেছে। বিভিন্ন সময়ে এই সংস্থাগুলি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে এবং যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) আহ্বান জানিয়েছে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এটি বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা প্রভাবিত করে। ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক এবং আরব দেশগুলি তাদের নিজ নিজ কৌশলগত স্বার্থের ভিত্তিতে সংঘাতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানায়।

ইরান ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করে, বিশেষ করে হামাস ও হিজবুল্লাহকে, যা ইসরায়েলের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করে। সৌদি আরব এবং মিশর কিছুটা মধ্যপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং শান্তির জন্য মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে।

আলোচনা ও শান্তি প্রচেষ্টা: দুই রাষ্ট্র সমাধান

দুই রাষ্ট্র সমাধান হলো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটি ধারণা, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, পশ্চিম তীর ও গাজায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে এবং ইসরায়েল জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করবে।

যদিও এই সমাধান অনেকের কাছে বাস্তবসম্মত মনে হয়, সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণ এবং জেরুজালেমের প্রশ্নে মতবিরোধের কারণে এটি প্রায়ই ব্যর্থ হয়েছে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, দুই রাষ্ট্র সমাধানই একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে পারে।

উপসংহার: সংঘাতের সমাধান খোঁজার পথে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল সংঘাতগুলির মধ্যে একটি, যেখানে ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি, এবং অর্থনীতির গভীর সংযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে শান্তি প্রচেষ্টা করা হলেও, মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে সীমান্ত নির্ধারণজেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণশরণার্থীদের অধিকার, এবং সেটেলমেন্ট সমস্যা ইত্যাদি বিষয় সংঘাতের মূলে রয়ে গেছে।

এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধানের জন্য দরকার হবে উভয় পক্ষের রাজনৈতিক ইচ্ছা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সমাধান প্রক্রিয়া। যদিও বর্তমান পরিস্থিতি জটিল, তবে দুই রাষ্ট্র সমাধান এবং সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সংঘাতের অবসানের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলছে।

এই বিশদ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত একটি বহুমুখী সমস্যা যা শুধু আঞ্চলিক সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সমাধান পেতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং উভয় পক্ষের জনগণের অধিকারকে সম্মানিত করতে হবে।