ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত জটিল এবং বিচিত্র। এই অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ভাষা, এবং ধর্মের এক মিলনস্থল হিসেবে পরিচিত। এটি একাধিক সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছে এবং বারবার রাজনৈতিক রূপান্তরের সাক্ষী হয়েছে।
এই প্রবন্ধে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিস্তারিত বিবরণ, প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক পর্যন্ত বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ব্রিটিশ শাসনের আগমন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আধুনিক ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে আলোচনা করব।
প্রাচীন ভারত: বৈদিক যুগ থেকে মৌর্য সাম্রাজ্য
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস শুরু হয় বৈদিক যুগ থেকে। এই সময়ে আর্যরা ভারতবর্ষে আগমন করে এবং একটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভিত্তি স্থাপন করে। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজতন্ত্রের ধারণা বিকশিত হয়। মহাভারত এবং রামায়ণের মতো মহাকাব্যগুলোও এই সময়ে রচিত হয়।
মহাজনপদ এবং মৌর্য সাম্রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে “মহাজনপদ” নামে পরিচিত ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো গঠিত হয়। এই মহাজনপদগুলোর মধ্যে মগধ, কোশল, এবং কুরু অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোকের শাসনকালকে ভারতীয় ইতিহাসে একটি বিশেষ যুগ হিসেবে ধরা হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার সাম্রাজ্যের মধ্যে শান্তি এবং ধর্মপ্রচার চালান।
গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং স্বর্ণযুগ
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গুপ্ত যুগকে “ভারতের স্বর্ণযুগ” বলা হয় কারণ এই সময়ে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং গণিতের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিখ্যাত শাসক ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত এবং চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়। এই সময়ে সংস্কৃত সাহিত্য, যেমন কালিদাসের রচনা, এবং গণিতে শূন্যের ব্যবহার প্রচলিত হয়।
মধ্যযুগে রাজনৈতিক বিবর্তন: দিল্লি সালতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্য
মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে।
দিল্লি সালতানাত
১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। কুতুবুদ্দিন আইবকের নেতৃত্বে এই সালতানাত গঠিত হয় এবং পরবর্তী শাসকরা ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন। দিল্লি সালতানাতের প্রধান শাসক ছিলেন ইলতুতমিশ, আলাউদ্দিন খলজি এবং মুহাম্মদ বিন তুঘলক। তাদের শাসনামলে কৃষি, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ উন্নতি ঘটে।
মুঘল সাম্রাজ্য
১৫২৬ সালে বাবরের নেতৃত্বে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। আকবর, শাহজাহান, এবং ঔরঙ্গজেবের মতো শক্তিশালী শাসকদের হাত ধরে মুঘল সাম্রাজ্য তার শীর্ষে পৌঁছে। মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে মন্দির, মসজিদ, এবং তাজমহলের মতো স্থাপত্য নির্মাণে বিশাল উন্নতি ঘটে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম ও হিন্দু সংস্কৃতির এক বিশেষ মিশ্রণ গড়ে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনের সূচনা এবং উপনিবেশিক যুগ
১৭৫৭ সালে প্লাসির যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা ঘটে। এ সময় কোম্পানি রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ধীরে ধীরে ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
কোম্পানি রাজ
প্লাসির যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় অর্থনীতি ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। কোম্পানি রাজের সময় কৃষি এবং বাণিজ্য থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করা হয়, কিন্তু এতে ভারতীয় কৃষক এবং কুটির শিল্পীদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ভারতের সম্পদ ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে স্থানান্তরিত হয় এবং ভারতীয় জনগণ দারিদ্র্যের শিকার হয়।
সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭)
১৮৫৭ সালে কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় আকারের বিদ্রোহ ঘটে, যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহটি কোম্পানি শাসনের অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অসন্তোষের প্রতিফলন ছিল। বিদ্রোহটি মূলত দিল্লি, কানপুর, ঝাঁসি, এবং লক্ষ্ণৌতে কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও বিদ্রোহটি সফল হয়নি, তবে এটি ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং ব্রিটিশ শাসন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে।
ব্রিটিশ রাজ: সরাসরি শাসনের যুগ
১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন শুরু করে, যা “ব্রিটিশ রাজ” নামে পরিচিত। রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের সম্রাজ্ঞী ঘোষিত হন এবং ব্রিটিশরা ভারতীয় প্রশাসন এবং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পায়। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব প্রদান করে।
গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন এবং অসীম সাহসিকতা
মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তার অসহযোগ আন্দোলন, লবণ আইন অমান্য আন্দোলন, এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে প্রদর্শন করে। গান্ধীর অহিংস আন্দোলন কৌশল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়।
ভারত বিভাজন এবং স্বাধীনতা
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয় এবং দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র – ভারত ও পাকিস্তান গঠিত হয়। বিভাজন প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল এবং এই সময়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে ও লাখো মানুষ উদ্বাস্তু হয়।
ভারত স্বাধীনতার পর একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, আর পাকিস্তান মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
স্বাধীনতা-উত্তর উপমহাদেশের রাজনৈতিক চিত্র
স্বাধীনতার পর ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পৃথকভাবে নিজেদের রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে। প্রত্যেকটি দেশ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থা, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলে।
ভারত
ভারতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খুব শক্তিশালী হয় এবং এ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। ভারত সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যের সঙ্গে তার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিশ্বে একটি বৃহৎ গণতন্ত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পাকিস্তান
পাকিস্তান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়েছে এবং সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে বিঘ্নিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র – বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের প্রভাব এখানেও লক্ষ্য করা গেছে।
উপসংহার
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং জটিল। প্রাচীন সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রা এই অঞ্চলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার পর ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ তাদের নিজস্ব পথে চলতে শুরু করে এবং প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের আলাদা রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু এই অঞ্চলের জন্যই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান